সহকর্মীকে বন্ধু ভেবে যেসব কথাগুলো বলা উচিত নয় | কর্মস্থলের সম্পর্কের গুরুত্ব
পরিচিতি (Introduction)
সোহেল ও নিশাত একই অফিসে কাজ করে। কাজ করতে করতে তারা খুবই ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। একদিন সোহেল, নিশাতের সঙ্গে মজা করে একটি ব্যক্তিগত মন্তব্য করে বসে, যেটা নিশাতকে কষ্ট দেয়। সে বিষয়টি অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে, এবং ধীরে ধীরে অফিসে সোহেলের বিরুদ্ধে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। বন্ধুত্ব থাকলেও, কাজের পরিবেশে কী বলা যায় আর কী যায় না—তা না বুঝলে পেশাগত সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই লেখাটিতে আমরা জানবো—সহকর্মীকে বন্ধু ভেবে যেসব কথা বলা উচিত নয়, কেন বলা উচিত নয় এবং কীভাবে সীমারেখা বজায় রেখে সুস্থ অফিস সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়।
১. অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা
অনেকেই বন্ধুত্বের কারণে সহকর্মীর সঙ্গে নিজের পারিবারিক সমস্যা, প্রেম-ভালোবাসার জটিলতা বা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য শেয়ার করে বসেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের অতিরিক্ত খোলামেলা হওয়া বিপদ ডেকে আনতে পারে।
উদাহরণ:
"আমার স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে অনেক দিন ধরে ঝগড়া চলছে" — এই ধরনের কথা সহকর্মী শুনে সহানুভূতি দেখালেও, ভবিষ্যতে আপনাকে নিয়ে গসিপ তৈরি হতে পারে।
২. অফিসের ভেতরের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা
সহকর্মীদের সঙ্গে বস, ম্যানেজমেন্ট, বা অন্য টিমের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য একেবারেই এড়িয়ে চলুন। আপনার ভাবা ‘বন্ধু’ হয়তো একদিন অন্য টিমে চলে যাবে বা সেই কথাগুলো কেউকে বলে দেবে।
৩. অফিস গসিপিং
অন্য সহকর্মীদের পেছনে কথা বলা, “কে কতটা কাজ করছে বা করছে না”, “কে বসের প্রিয়” — এসব কথাবার্তা শেষ পর্যন্ত গিয়ে আপনার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
স্মরণ রাখুন: গসিপ কখনো গোপন থাকে না। আজ যে গসিপ করছে, কাল আপনাকে নিয়েই তা করবে।
৪. ব্যক্তিগত সম্পর্কের অতিরিক্ত আলোচনা
প্রেম, বিয়ে, ডেটিং, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে অতিরিক্ত আলোচনা কাজের পরিবেশকে অস্বস্তিকর করে তোলে, বিশেষ করে যদি অপরপক্ষ এসব বিষয়ে অস্বস্তি অনুভব করে।
৫. সহকর্মীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ
"তোমার বয়স কত?", "তুমি বিয়ে করো না কেন?", "তোমার পরিবারে কেউ রাজনীতি করে?" — এসব প্রশ্ন বন্ধুত্বের নামে করা হলেও অনেক সময় অন্য পক্ষকে অস্বস্তিতে ফেলে।
৬. ধর্ম, রাজনীতি ও জাতিগত বিষয়
এই বিষয়গুলো খুব সংবেদনশীল এবং কারো বিশ্বাসে আঘাত করতে পারে। বন্ধুর সঙ্গে হালকা কথা বলার সময়ও এইসব স্পর্শকাতর বিষয় এড়িয়ে চলা উত্তম।
৭. অতিরিক্ত ব্যক্তিগত রসিকতা
বন্ধুত্ব থাকলেও, ব্যক্তিগত বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাস্যরস (যেমন: “তুমি তো মটকা হয়ে যাচ্ছো”, “চুল পড়ে যাচ্ছে দেখছি”) সম্পূর্ণ এড়ানো উচিত। এতে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া বা অফিসের অভিযোগ পর্যন্ত গড়াতে পারে।
৮. মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট বা উপদেশ
বন্ধুর মতো উপদেশ দিতে গিয়ে অনেক সময় আমরা বলি—
“তুমি এটা ভুল করছো”, “তোমার উচিত ছিল এটা না করা”।
এসব উপদেশ যদি আপনার ভূমিকার বাইরে যায়, তবে সেটা উল্টো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আনতে পারে।
৯. অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা
বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে বারবার ফেভার চাওয়া যেমন রিপোর্ট বানানো, ক্লায়েন্ট হ্যান্ডলিং করে দেওয়া ইত্যাদি সহকর্মীর ওপর চাপ তৈরি করে। এতে সেই ব্যক্তি বিরক্ত হতে পারে এবং আপনাকে 'অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়া' ব্যক্তি ভাবতে পারে।
১০. অফিসের নিয়ম-নীতি নিয়ে হাস্যরস করা
“এই অফিসে তো কিছুই ঠিক নেই”, “বস তো কিছু বোঝেন না”—এই ধরনের মন্তব্য বন্ধুর সামনে করলেও তা যদি অন্য কেউ শুনে ফেলে, তবে সেটি আপনার ক্যারিয়ার ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
১১. অতীত বা পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন
সহকর্মীকে বন্ধু মনে করে "তোমার বাবা কী করতেন?", "তুমি কোন গ্রামে থাকো?" এইসব প্রশ্ন যদি প্রাসঙ্গিক না হয়, তাহলে অনেকেই বিরক্ত হতে পারেন।
১২. সহকর্মীর পোশাক বা বাহ্যিকতা নিয়ে মন্তব্য
“আজ তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে”, “এই রঙটা তোমার গায়ে একদম মানায় না”— এই ধরনের মন্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত ফ্লার্টিং মনে হতে পারে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগ পর্যন্ত গড়াতে পারে।
১৩. সোশ্যাল মিডিয়াতে অতিরিক্ত ট্যাগ, কমেন্ট বা ফলোআপ
অনেকেই অফিস ফ্রেন্ডকে ফেসবুকে বন্ধুর মতো মনে করে মেসেজ করা, পোস্টে ট্যাগ করা বা ব্যক্তিগত মন্তব্য করে ফেলেন। কর্মস্থলের মানুষ এসব পছন্দ না-ও করতে পারে।
১৪. অফিসের সমস্যার জন্য অন্য সহকর্মীকে দোষারোপ
কোনো কাজ সময়মতো না হলে বা চাপ বাড়লে বন্ধুকে দোষারোপ করা সম্পর্ক নষ্ট করে। বরং দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া সম্পর্ককে শক্ত করে।
১৫. পার্টি বা আড্ডার আমন্ত্রণ নিয়ে মন খারাপ
সব বন্ধুই সব আড্ডায় ডাকবে না। আপনি সহকর্মীর বন্ধুও হতে পারেন, কিন্তু সেটা তার ব্যক্তিগত চক্রের অংশ নাও হতে পারে। এটা স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখুন।
উপসংহার: অফিসে বন্ধুত্ব হোক পেশাদারিত্বের ছায়ায়
কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মাঝে কোনো সমস্যা নেই। বরং এটা কাজের উৎসাহ বাড়ায়। তবে, বন্ধুত্ব মানেই সব কিছু বলা যাবে — এই ধারণা ভুল। সঠিক সীমা বজায় রেখে সম্পর্ক গড়ে তুললেই সেই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী ও সুস্থ হয়।
Comments
Post a Comment